Post Page After Menubar Ad

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ - গোষ্ঠী সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন



২০১১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশ আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ - গোষ্ঠী রয়েছে ২৭ টি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ৫৫ টির অধিক আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশে। এদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের বেশি।। আমরা আজ বাংলাদেশে যারা নৃ - গোষ্ঠী বসবাস করে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।



এখনো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ - গোষ্ঠী সময়ের সাথে সভ্যতার পরিবর্তন হয়নি। এসব জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন ঠিক আগের মতই রয়ে গেছে। বর্তমানে কিছু নিগোষ্ঠীর উচ্চ শিক্ষা প্রযুক্তি আধুনিকতার ছায়া লেগেছে কিন্তু তা খুব সামান্য ।

ভূমিকা

বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ - গোষ্ঠী বসবাস করে। এদের মধ্যে রয়েছে গারো সম্প্রদায় খাসিয়া সম্প্রদায় ওরাও সম্প্রদায় চাকমা সম্প্রদায় ইত্যাদি। এসব জনগোষ্ঠীর বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবো এই আলোচনায় ‌। এই লেখাটি পুরোপুরি পরলে আপনারা এসব জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।


গারো জনগোষ্ঠী

ধারণা করা হয় গারো জনগোষ্ঠী প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে তিব্বত থেকে এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস শুরু করেন। গারোদের নিজস্ব ভাষার নাম আশিক বা গারো ভাষা। গারদের আদি ধর্মের নাম সাংসারিক। তবে বর্তমানে বেশিরভাগ গারো খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ নারীরাই পরিবারের প্রধান এবং সম্পত্তির অধিকারী। 

মাতার সূত্র ধরেই তাদের দল, গোত্র এবং বংশ গড়ে ওঠে। গারোদের প্রধান খাবার, ভাত, মাছ মাংস ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। তাদের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার বাসের গোড়ল দিয়ে তৈরি করা হয় যা খেতে অনেক সুস্বাদু। পূর্বে কারো জনগোষ্ঠীর লোকেরা বিভিন্ন নদীর তীরে লম্বা এক ধরনের বাড়ি তৈরি করতেন যা নক মান্দি নামে পরিচিত। 

তবে বর্তমানে ওদের অন্যদের মতোই করো গেটেড টিন এবং অন্যান্য উপকরণ দিয়ে বাড়িঘর তৈরি করে থাকেন। গারো নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম দক বান্দা ও দক শাড়ি। এবং পুরুষ মানুষ শার্ট , লুঙ্গি, ধুতি ইত্যাদি ব্যবহার করে। গারোদের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের নাম ওয়ান গালা। এ সময় তারা সূর্য দেবতার সাল জং এর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নতুন শস্য উৎসর্গ করেন।

সাধারণত নতুন শস্য ওঠার সময় অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে উৎসবটি হয়। উৎসবের শুরুতে তারা উৎপাদিত শস্য অর্ঘ্য হিসাবে নিবেদন করেন এবং বিভিন্ন ধরনের বাদ্য বাজনা বাজিয়ে এর উৎসবটি পালন করে থাকেন।

খাসিয়া নৃ - গোষ্ঠী

ধারণা করা হয় ৫০০ বছর আগে আসাম থেকে বাংলাদেশে সিলেক্ট বিভিন্ন এলাকায় খাসিয়া নিবি গোষ্ঠী বসবাস শুরু করেন। অতীতের সিলেটের জয়ন্তা নামে একটি রাজ্য ছিল খাসিয়া জনগোষ্ঠী ওই রাজ্যে বসবাস করতেন বলে জানা যায়। শিয়ারা গ্রামকে সাধারণত পুঞ্জি বলে। জীবিকার জন্য তারা দলে দলে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বসবাস করেন এবং নতুন নতুন পুঞ্জি রচনা করে।

খাসিয়া সম্প্রদায় পুঞ্জি প্রধান কে সিএম বলে ডাকা হয়। গারোদের মতই এশিয়ানী গুষ্টির নিজস্ব ভাষা আছে। এদের লিখিত কোন বর্ণমালা নেই তাদের ভাষার নাম মন কেমন। এই জনগোষ্ঠীর সময় ব্যবস্থা ও গাঢ় সম্প্রদায়ের মতোই মাতৃতান্ত্রিক। পরিবারের সম্পত্তির বেশিরভাগ উত্তারাধিকার হয় পরিবারের সবচেয়ে ছোট মেয়ে। এসব জনগোষ্ঠী কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। 

তারা প্রচুর পান ও মধু চাষ করে। খাসিদের প্রধান খাবার ভাত মাছ শুটকি মাছ মধু ইত্যাদি। তারা সাধারণত পান সুপারিকেই খুব পবিত্র মনে করেন। বাড়িতে কোন অতিথি এলে পান সুপারি চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। খাসিয়া মেয়েদের কামিজ পিন নামক ব্লাউজ ও লুঙ্গি পরে। আর ছেলেরা পকেট ছাড়া শার্ট ও লুঙ্গি পরে যার নাম ফুংগ মারুং । খাসিয়ারা বিভিন্ন দেবতার পূজা করেন।

তাদের প্রধান দেবতার নাম যাকে তারা পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা মনে করেন। এসব জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পালন পারেন যেমন পূজা-পার্বণ, বিয়ে করা, অতিবৃষ্টি , ফসলহানি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নাচ-গান করা হয়। এসব উপলক্ষে খাসিয়া জনগোষ্ঠী উৎসবের আয়োজন করে থাকেন।

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ শ্রেণীর মানুষের বসবাস। তার মধ্যে আরেকটি জনগোষ্ঠী হল ত্রিপুরা। এদের নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য বিভিন্ন আকার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাদেশে তৃতীয় বৃহত্তম এই জনগোষ্ঠী হলো ত্রিপুরা। এরা সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলের আরেকটি গ্রেথ জনগোষ্ঠী নাম ত্রিপুরা। চাকমা ও মারমাদের পর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এই জনগোষ্ঠী বসবাস করে।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন জাতি এই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী। বহু বছর আগে থেকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ নদীর তীরে বসবাস করত বলে তাদেরকে পরিচিত ছিল। ত্রিপুরাদের ভাষার নাম ককবর। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সমাজে দলবদ্ধভাবে বসবাস করেন। দলকে তারা দফা বলে। তাদের মোট ৩৬ টি দফা আছে। এদের মধ্যে ১৬ টি বাংলাদেশে আর বাকি বৃষ্টি ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যে রয়েছে।

বাংলাদেশে বসবাসকারী ত্রিপুরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অধিকারী। তবে বাবার সম্পত্তি ছেলেরা আর মায়ের সম্পত্তি মেয়েরা লাভ করে থাকে। ত্রিপুরা রা সনাতন ধর্মের অনুসারী। তবে বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং শিব ও কালী পূজা করেন। তারা নিজস্ব কিছু দেবদেবীর উপাসনাও করেন। গ্রামের সকল লোকের মঙ্গলের জন্য তারা কের পূজা করেন। ত্রিপুরাদের ঘর গুলো সাধারণত উঁচুতে হয়

এবং ঘরে ওঠার জন্য সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়। ত্রিপুরা মেয়েদের পোশাকের নিচের অংশকে রিনাই ও উপরের অংশকে রিসা বলা হয়। মেয়েরা নানারকম অলংকার পুতির মালা আর কানে নাতং নামে একপ্রকার দুল পড়ে। ছেলেরা ধুতি গামছা লুঙ্গি জমা করেন। ত্রিপুরা রা সমাজে মৃত্যুর, জম্ম , বিয়ে উপলক্ষে নানা ধরনের অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তাদের নববর্ষের উৎসব বৈসু ।

এ সময় ত্রিপুরা নারীরা মাথায় ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজান। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান ও আনন্দ করেন।

চাকমা জনগোষ্ঠী

আদিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশের চাকমা জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বড়। ভারতের উত্তর পূর্বে কিছু অংশ এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে এরা বসতি স্থাপন করে। চাকমা জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস জানা যায় না। ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে চাকমাদের ভাগ্য ফিরে আসে। এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী চট্টগ্রাম অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে বসবাসের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

কৃষিকাজ হচ্ছে চাকমাদের প্রধান জীবিকা। পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষ করে বিভিন্ন রবিশস্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করে থাকে তারা। চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালা আছে। এসব জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি রয়েছে। চাকমারা যেসব জামাকাপড় পরিধান করে তারা নিজেরাই তৈরি করেন এবং নিজেরাই ডিজাইন করেন। চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রের নাম হল পিনন হাদী বিভিন্ন নকশা সত্তর সংমিশ্রণে এটা তৈরি হয়ে থাকে। 

পোশাকের নিচের অংশকে এরা পিনন যা কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত উপরের অংশকে হাতি বলা হয়। এসব হাদীর সঙ্গে তারা ব্লাউজ পড়ে থাকেন। প্রত্যেক বছর বিভিন্ন উৎসব করে থাকেন চাকমা সম্প্রদায়। এসব উৎসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বদ্ধ পূর্ণিমা। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের পূর্ণিমার দিনে এই উৎসবটি পালন করে থাকে। এসব উৎসবের সময় এসব চাকমা জনগোষ্ঠীরা জাঁকজমক পোশাক পড়ে বিভিন্ন মন্দিরে যায়।

এ সময় তারা বিভিন্ন গৌতম বুদ্ধের মূর্তিতে ফুল এবং মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে। এসব মন্দিরের পুরোহিতদের কাছ থেকে অনেক বাণী শুনেন। বিজু উৎসব হল চাকমা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব। চাকমা সাধারণত বাড়িতে বাড়ি তৈরি করে থাকেন মাটির উপর থেকে প্রায় ৬ ফুট উপরে মাথার উপর নির্মাণ করা হয় এসব বাড়ি। এবং ওঠার জন্য একটি কাঠের সিঁড়ি ব্যবহার করেন তারা।

আমাদের প্রধান খাদ্যদ্রব্য হল চাল ভুট্টা শাকসবজি ইত্যাদি। তারা মাছ-মাংস এমন কি শুয়েরেও মাংস খায় ‌। এসব  সম্প্রদায় মদ পানকারী হিসেবে সুপরিচিত। বিশেষ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা অবাধে মদ খায় এটা তাদের এক ধরনের ঐতিহ্য।

ওরাও জনগোষ্ঠী

ওরাও জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ রাজশাহীর রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে বসবাস করেন। ওরাও সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। রাউদের গ্রাম প্রধানকে মাহাতো বলা হয়। তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক পরিষদ আছে যা ফাহাতো নামে পরিচিত। এই পরিষদের কয়েকটি গ্রামের প্রতিনিধিরা থাকেন। ওরাও জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দেবতার পূজা করেন। তাদের প্রধান দেবতা ধর্মী বা ধর্মেশ যাকে তারা পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা মনে করে।

এদের প্রধান উৎসবের নাম কারাম। ভাদ্র মাসে উদিত চাঁদের শুক্ল পক্ষের একাদশী তিথিতে কারামু উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও তারা প্রতিমাসে ও ঋতুতে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্রত অনুষ্ঠান পালন করেন। ওরাও দের পুরুষেরা ধুতি, লুঙ্গি্শার্ট ও প্যান্ট পরে। মেয়েরা মোটা কাপড়ে শাড়ি ও ব্লাউজ পড়েন। ওরাও দের প্রধান খাবার ভাত। এছাড়াও তারা গোম , ভুট্টা , মাছ-মাংস ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি খেয়ে থাকেন।

লেখকের মন্তব্য

বাংলাদেশের  বিভিন্ন আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর বসবাস করে থাকে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ - গোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের উৎসব তারা পালন করে থাকে। এসব নৃ - গুষ্টির প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য আছে। এসব আদিবাসীরা যার যার উৎসব তারা বিভিন্ন রকম ভাবে পালন করে থাকে। এসব জনগোষ্ঠীর কিছু আলাপ-আলোচনা করেছি যদি আপনাদের এই আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকে তবে একটা লাইক দিবেন এবং বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করবেন।






এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url